শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের অজানা ইতিহাসঃ প্রথম পর্ব

প্রতিবেদক

ফিলিস্তিন

মুফতি ইমরান বিন বশির

সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে আমরা সকলেই মর্মাহত, দুঃখ ভারাক্রান্ত। পুরো মুসলিম বিশ্ব ক্ষুব্ধ, ক্ষীপ্র। আলেম ওলামা, তৌহিদি জনতা, সাধারণ জনতা সবাই নেমেছে রাজপথে। বিক্ষুব্ধ মিছিল করছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় কেএফসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হচ্ছে।

হয়তো মানুষ হিসেবে গাজার নিষ্পাপ প্রাণগুলো ঝরতে দেখে, ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখে আমাদের সকলেরই মানব মন ব্যথিত হয়ে উঠছে। চোখের কোণ ভিজে উঠছে, প্রতিবাদী হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠছে ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে, খুবই স্বাভাবিক।

শুধু আজ নয়, এ রক্তখেলা চলছে বেশ কয়েক বছর কি, কয়েক যুগ ধরে।

একদিকে গাজার মুসলিমরা আহত ও নিহত হলে আমরা কাঁদি, চোখের জলে ভাসি। আরেক দিকে ইসরাইলি বাহিনী আহত ও নিহত হলে আমরা আল্লাহর শুকর আদায় করি। আলহামদুলিল্লাহ বলি। আনন্দ অনুভব করি। আমাদের চোখের জলগুলো যেন শুধু মুসলিমদের জন্য, আর আমাদের প্রতিবাদী মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো যেন অমুসলিমদের জন্য। আমাদের কান্না, মায়া, ভালোবাসা যেন মুসলিমদের জন্য, আর আমাদের ঘৃণা, সহিংসতা, নির্মমতা সবই যেন অমুসলিমদের জন্য।

এটি হয়তো খুব স্বাভাবিক। কারণ ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমাদের কাছে ইসরাইলিরা হলো খলনায়ক। আর ফিলিস্তিনিরা শক্তিধর এক খলনায়কের কাছে পরাস্ত, নিষ্পেষিত, অসহায়, নিরীহ একটি চরিত্র।

যে কোনো প্রাণই ঝড়ুক, যে কোনো মানুষই মরুক, একজন মানুষ হিসেবে তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমি বা আমরা কখনই তা কামনা কর‍তে পারি না। কে কোন ধর্মের , কে কোন বর্ণের, কে কোন জাতি, কে কোন প্রজাতি, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা সর্বদাই ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায় অপরাধের বিপক্ষে, এমনি মানসিকতাই হওয়া উচিত।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে কে আসল নায়ক, কে খলনায়ক, কে আসামি, কে নিরপরাধ তা নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে জানতে হবে।

ভিডিওটি যদিও দীর্ঘ হবে তবু আপনার আমার চোখের পানি কাদের জন্য ঝরা উচিত, কতটুকু ঝরা উচিত, শুধুই কি চোখের পানি ফেললেই হবে? কী করা উচিত, কী না করা উচিত, সবকিছুর যথাযথ দিকনির্দেশনা পেতে অবশ্যই গোড়া থেকে ইতিহাসটি বোঝা উচিত।

চলুন শুরু করা যাক।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বহুল জনপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল এই যুদ্ধটি কি ধর্মীয়, নাকি রাজনৈতিক, নাকি ভূখন্ডের লড়াই?

এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় যদিও দেওয়া সম্ভব না। আগা গোড়া ইতিহাস পাঠের পরই মিলবে এর সদুত্তর। জানা যাবে এটি আসলে মূলত ভূখন্ডের লড়াই থেকে শুরু করে রাজনীতি, রাজনীতি থেকে ধর্মনীতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান অবস্থা যে কেবলি ধর্মভিত্তিক একটি যুদ্ধ, তা হয়তো বলার প্রয়োজন নেই।

যেহেতু আমি ধর্মের ছাত্র আর এই যুদ্ধটিও ধর্মের ওপর ভিত্তি করেই, সেহেতু এই বিষয়ে আদ্যপ্রান্ত বলবার প্রয়োজন অনুভব করছি। এই ইস্যুতে আরেকটি জনপ্রিয় প্রশ্ন হলো ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসি কারা? মুসলিমরা নাকি ইহুদিরা?

সহজ এবং নিকটতম ইতিহাসের সোজা হিসেব মতে যদি বলি, ইসলাম ধর্মের বয়স ১৪৫০ বছর। আর ইহুদি ধর্মের বয়স আনুমানিক ৩৫০০ বছর। সুতরাং ইসলামের আগে ইহুদি ধর্ম এসেছে। সেই হিসেবে ইহুদিরাই ফিলিস্তিনের আদি বা বৈধ অধিবাসী।

কেননা, ইসলামের নবী নবুওতের দাবি করবার পর ১৩ বছর মক্কায় এবং ১০ বছর মদিনায় কাটান। মক্কায় ১৩ বছর থাকাকালীন এবং মদীনায় হিজরতের পরেও ১৯ মাস যাবৎ ইহুদিদের মসজিদুল আকসার দিকে ফিরেই সালাত আদায় করতেন। 

এর কারণ হিসেবে বলা হয়, মদিনায় অধিকাংশ লোক ইহুদি ছিলো। তাই ইহুদিদের খুশি রাখতে তাদের কিবলা মসজিদে আকসার দিকে ফিরেই সালাত আদায় করতেন তিনি। রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই অসম্প্রদায়িক কাজটি খুবই ভালো এবং প্রশংসনীয় ছিলো। যদিও পরবর্তীতে আল্লাহ সূরা বাকারার ১৪৪ নং আয়াত নামিয়ে মুসলিমদের কিবলা মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদুল হারাম বা কাবা শরিফে পরিবর্তন করে দেন। 

কিবলা পরিবর্তনের এই আচমকা বিধানটি নিয়ে রসুল সা. ও ইসলাম যথেষ্ট সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

ইহুদিরা প্রশ্ন করল,

‎مَا وَلّٰىہُمۡ عَنۡ قِبۡلَتِہِمُ الَّتِیۡ کَانُوۡا عَلَیۡہَا ؕ

তারা এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করে আসছিল তা হতে কিসে তাদেরকে ফিরিয়ে দিল?

এই প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ নবীর মাধ্যমে এভাবে দিলেন,

‎قُلۡ لِّلّٰہِ الۡمَشۡرِقُ وَالۡمَغۡرِبُ

বলো, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।

কিন্তু আল্লাহ বা নবীর এই উত্তরে ইহুদিরা হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

সত্যিই তো! পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই হলে, আল্লাহ প্রথমে কেন মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে বললেন? আল্লাহ, যিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত জানেন, তার পক্ষে আগে এক রকম বিধান দিয়ে তারপর আবার এমন হঠাৎ পরিবর্তনের বিধান দিবেন, এটি আসলে মানা যায় না।

তিনি কি জানতেন না পূর্ব পশ্চিম তারই? জানলে, আগে থেকেই কাবাকে কিবলা বানালেন না কেন?

আমাদের প্রিয় নবীও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, এই উত্তর খুব একটা সদুত্ত হয়নি। তাই হয়তো আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন, আরেকটি  সুন্দর, যুৎসই, সদুত্তর দিতে।

আয়াত নাজিল হলো আরেকটি,

‎وَمَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ کُنۡتَ عَلَیۡہَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡہِ

তুমি এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করছিলে একে আমি এ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যাতে জানতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে আর কে ফিরে যায়। 

এই উত্তরটিও কি সদুত্তর হয়েছে?

আরো অনেক বিষয় আছে এই পরীক্ষা করার জন্য যে নবীকে কে অনুসরণ করলো, আর কে করলো না!

যাই হোক, এই কথাগুলো এজন্য বললাম, যাতে বোঝা যায়, মুসলিমদের আগেই ইহুদি ধর্ম এবং তাদের কিবলা ইতিমধ্যেই জেরুজালেমে অবস্থিত, এবং সেদিকে ফিরেই বরং মুসলিমরা দীর্ঘ কাল সালাত আদায় করেছে।

এক কথায় ইহুদিদের তীর্থভূমি হলো ফিলিস্তিন। মুসলিমরা তখন কেবল আরবেই আছে। মক্কা বা মদিনায়। 

এটি স্পষ্ট যে ধর্মীয়ভাবে ফিলিস্তিন ইহুদিদেরই ভূমি। কিন্তু মুসলিমরা এটি মানতে নারাজ। তারা ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের সময়কালের আগের সময়ের হিসেবে দাবি করেন যে ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসী আরবরাই ছিলো। তার মানে এই যুদ্ধটি একটি জাতিগত লড়াই। ভূখণ্ডের লড়াই। এখানে ধর্মের কোনো ছোঁয়া নেই।

কিন্তু ধর্ম ঠিক কবে, কখন ঢুকে গেছে, সেটিও আমরা আজ জানবো। চলুন তাইলে আরেকটু গভীরে যাই।

ইতিহাস বলে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার বাহক। এটি সেই প্রথম ভূখণ্ড, যেখানে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৯ হাজার বা ১০ হাজার বছর আগে মানুষ খেত-খামার ও স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছিল। পরবর্তী ১ বা দুই হাজার বছর পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮ বা ৯ হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে ‘আরিহা’ নামক নগরী।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরিহা (Jericho), যা বর্তমানে ফিলিস্তিন অঞ্চলে অবস্থিত, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর হিসেবে বিবেচিত। এটি প্রাচীন কালে অনেকবার ধ্বংস ও পুনঃর্নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু সেটি কিভাবে ধ্বংস হলো, কে বা কারা ধ্বংস করলো, কেন করলো, নাকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধ্বংস হলো, এ নিয়ে আছে নানা বক্তব্য ও মন্তব্য । 

তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ধ্বংসের কাহিনি পাওয়া যায় বাইবেল-এ, বিশেষ করে পুরাতন নিয়ম (Old Testament)-এর Joshua বইতে।

মুসলিমদের ইতিহাসে বলা হয় ফিলিস্তিন অঞ্চলের বসবাসকারী হিসেবে সর্বপ্রথম যাদের কথা জানা যায় তারা হলো ‘ক্যানানি’ গোত্র। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ একমত। তারা  খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে আরব উপদ্বীপ থেকে হিজরত করে এসেছিলো। ক্যানানীয়রা সেমিটিক ভাষাভাষী একটি জাতি ছিল, এবং তারা বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানের কিছু অংশে বসবাস করত।

ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যানানীয়িদের বিভিন্ন শাখা বসবাস করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের ভিতরে তারা ফিলিস্তিন এলাকায় প্রায় ২০০টির মত শহর গড়ে তোলে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল য়াবুস শহর। এ শহরের গোড়াপত্তন করেছিলো ক্যানানীয়দের  য়াবুস শাখা। এ শহরই বর্তমান কুদস বা জেরুজালেম। 

পরে এই অঞ্চলে আরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী আসে—যেমন হিব্রুরা (ইসরায়েলীয়), ফিলিস্তীয় (Philistines, যারা মূলত এজিয়ান অঞ্চল থেকে এসেছিল), অ্যাসিরিয়ান, বাবিলোনিয়ান, পার্সিয়ান, গ্রিক, রোমান, আরব, ওসমান তুর্কি ইত্যাদি। কিন্তু ক্যানানীয়দেরকেই ইতিহাসে ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রাচীনতম বা মূল আদিবাসী হিসেবে ধরা হয়।

মুসলিমরা এটি বলে ফিলিস্তিনের মূল আদি বাসী যে মুসলিমরা, আরবরা, এই ভূখন্ডে মুসলিমদের হক ও অধিকার রয়েছে, এটি বোঝাতে চান। কিন্তু কয়েকটি কারণে এই বুঝ মানা যায় না।

এক. 

ক্যানানিয়রা তো খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে আরব উপদ্বীপ থেকে হিজরত করে এসেছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালের আগে খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কাদের বসবাস ছিলো? হিজরত করে আসা লোকেরা এখানকার স্থানীয় হয় কিভাবে?

দুই.

হয়তো তারা বলবেন, ফিলিস্তিনের ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট করে জানা যায় না সর্বপ্রথম কারা এখানে বাস করতো। তবে প্রত্মতাত্মিক নিদর্শন দ্বারা ইংগিত পাওয়া যায় ‘নিতুফিয়্যূন’ নামে এক জাতি বাস করতো। তারা কারা? কেউ বলতে পারে না। বর্তমান ‘আরিহা’-য় কিছু ঘর-বাড়ি পাওয়া যায় কিন্তু এগুলোতে কারা থাকতো সে ব্যাপারেও কিছু জানা যায় না। 

যেহেতু এই বিষয়ে ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব খুব পরিষ্কার নয়, এবং লিখিত ইতিহাস ক্যানানীয়দের সময় থেকেই বেশি স্পষ্ট হতে শুরু করে তাই ক্যানানীয়রাই ফিলিস্তিনের মূল বাসিন্দা। কিন্তু এটিও মানা যায় না, প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কথা বলে কি ক্যানানীয়দের আগের মানুষদের ফিলিস্তিনের আদি বাসী বলা যাবে না?

প্রত্নতাত্ত্বিকরা তো এটা বুঝতে পেরেছে যে, ক্যানানীয়দের আগে বহু কাল ধরে এখানে মানুষ বসবাস করেছে। তবে কেন আরব উপদ্বীপ বা আশেপাশের এলাকা থেকে হিজরত করে আসা অভিবাসী ক্যানানীয়দের ফিলিস্তিনের স্থায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দা ধরা হবে?

তিন.

যদি মেনেই নেওয়া হয়, ক্যানানীয়রাই ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসী, তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে বসবাস করা ক্যানানীয়দের কারণে বর্তমানে আরবদের ফিলিস্তিন দখল করার বৈধতা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না।

এত দীর্ঘকাল পরে এসে যদি কেউ বলে, যেহেতু অতীতে আমাদের বাপ দাদারা এখানে রাজত্ব করেছিলেন, তাই এখন আমরা এখানে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে শাসনকার্য পরিচালিত করব। বলুন তো, এ থিউরি যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! রেড ইন্ডিয়ানরা বলবে, আমেরিকায় তো আমাদের শত শত বছরের রাজত্ব ছিল। আর এ ইতিহাস বেশি পুরাতনও নয়।  তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আমেরিকার জনগণকে সেখান থেকে বের করে দিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। শুধু এক জায়গার কথা নয়, পুরো বিশ্বে যদি আপনি এ নীতি প্রয়োগ করেন তাহলে তো বর্তমান পৃথিবীটাই শেষ হয়ে যাবে। শত-সহস্র বছর পূর্বের লোকদের উত্তরসূরিরা এসে বসতি স্থাপন করবে আর বর্তমান অধিবাসীদের বিতাড়িত করবে- এটা কি কোনো সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে?! 

চার.

এভাবে কেউ বলতে পারে, ক্যানানীয়রা যেহেতু আরব উপদ্বীপ থেকে এসেছিল ফিলিস্তিনে, আরব যেহেতু এখন মুসলিম, তাই ইসলামের খাতিরে, মুসলিমদের এই ফিলিস্তিনের ওপর অধিকার আছে। কিন্তু এটিও বলা যায় না। কারণ ক্যানানীয়রা আরব হলেও মুসলিম ছিলো না। তারা ছিলো পৌত্তলিক। নবী মোহাম্মদ যাদের সঙ্গে আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন।

কুরআনের ৯:৫ আয়াতে বলা হয়েছে,

‎فَاقۡتُلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ حَیۡثُ وَجَدۡتُّمُوۡہُمۡ وَخُذُوۡہُمۡ وَاحۡصُرُوۡہُمۡ وَاقۡعُدُوۡا لَہُمۡ کُلَّ مَرۡصَدٍ ۚ

মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদেরকে বন্দী করবে, অবরোধ করবে আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্যে ওঁৎ পেতে থাকবে। 

সুতরাং সেই মুশরিক বা পৌত্তলিক ক্যানানীয়রা কোনো এক কালে ফিলিস্তিনে হিজরত করে অভিবাসন নিয়েছিলো বলে এত হাজার বছর পর এখন মুসলিমরা দাবি করতে পারে না যে, ফিলিস্তিনের মাটি আমাদের পূর্বপুরুষদের। এই ভূখন্ডে আমাদের হক আছে।

তাহলে কারা হবেন ফিলিস্তিনের বৈধ উত্তরসূরি? যেহেতু এই ভূখন্ডের পূর্বপুরুষদের কথা ইতিহাসে নেই, তাই নাহয় সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। পরে এই পুণ্য ও ঊর্বর ভূমিতে নানান জায়গা থেকেই মানুষ এসে বসত গড়েছে।

কারা এসেছে? বহু জাতিগোষ্ঠী এসেছে। ক্যানানীয়, ফিলিস্তীয়, হিব্রু/ ইসরায়েলীয়,আসিরীয়, ব্যাবিলোনীয়, পারস্য, গ্রিক-আলেকজান্ডার, রোমান, বাইজেন্টাইন, মুসলিম, ক্রুসেডার, বৃটিশ বহু জাতি এসেছে এই ভূখণ্ডে।

সবাই-ই তো এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা বাসিন্দা। হিজরতকারী, দেশান্তরী, বা অভিবাসী। প্রশ্ন হলো, আমরা কাদের এই ভূখন্ডের বৈধ উত্তরসূরি ধরবো? সবাইকেই?

না, সবাই বৈধ হতে পারে না।

যারা ধর্মের নামে বা গায়ের জোর দেখিয়ে জোরজবরদস্তিমূলক এই ভূখণ্ড দখল করেছে, আমরা কেবল তাদেরই অবৈধ বলতে পারি।

একটু বুঝুন, একটা ভূখণ্ড খালি পড়ে আছে। এই ভুখন্ডের মালিক কেউ না। সেখানে কিছু মানুষ এসে থাকা শুরু করেছে। নিজেরা কৃষিকাজ করছে, পরিশ্রম করছে, খাচ্ছে, পরছে, থাকছে। কোনো সমস্যা না।

সেখানে আরো কিছু জায়গা খালি আছে, আরো কিছু মানুষ এসে সেখানে বসত গড়ছে। কোনো সমস্যা না। সবাই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করলে সমস্যা কোথায়।

সমস্যা হবে তখন, যখন এই জায়গা ভরে যাওয়ার পরে, কিছু মানুষ এখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে জায়গাটি দখল কর‍তে চাইবে বা এই জায়গায় সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস কালে কোনো এক জাতি এদের ওপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করবে তখন।

দুঃখজনক সত্যি হলো, ইতিহাসের প্রাচীন, ঊর্বর এই ভূখণ্ডে যুগে যুগে বহু জাতি এসে আধিপত্য বিস্তার করেছে। যুদ্ধ করেছে। ইতিপূর্বে এই ভুখণ্ডে বসবাসরত স্থানীয়দের উৎখাত করে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে জোরজবরদস্তি করে।

আজ আমাদের আলোচনায়, ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ইতিহাসে এরাই হলো খলনায়ক।

ফিলিস্তিন ইতিহাসে এই খলনায়কদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। আমি পুরো ইতিহাস পূঙ্খানুপুঙ্খ বলব না। এত ধৈর্য্য আপনাদের থাকবে না হয়তো।  তবে আমি এখানে নিকটতম ইতিহাস ইসলাম ও ইহুদিদের যোগসূত্রের কথা বলব।

ঈসা বা জিসু খ্রিষ্টের জন্মের আগের সময়টাকে আমরা খ্রিষ্টপূর্ব সাল বলি। ঈসা আ. এর জন্মের পরের সময়টাকে খ্রিষ্টাব্দ বলি। পূর্বে আমি উল্লেখ করেছি খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ থেকে ২০০০ সালে আরব উপদ্বীপ বা আশেপাশের এলাকা থেকে ক্যানানীয়রা ফিলিস্তিন আসে। এর আগের ইতিহাসগুলো সংরক্ষিত নেই। তাই এখান থেকেই ইতিহাস পর্যালোচনা হচ্ছে।

ক্যানানীয়দের বিভিন্ন শাখা ফিলিস্তিন এসে বসবাস শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের  ভেতরে ২০০ টির মতো শহর গড়ে তোলে। তন্মধ্যে য়াবুস শহর অন্যতম। এ শহর গোড়াপত্তন করেছিলো ক্যানানীয়দের য়াবুস শাখা।  এই শহরটিই বর্তমানে কুদস বা জেরুজালেম। 

ভূমধ্যসাগর এলাকা থেকে অনেক মানুষ এসে শাম ও মিসরের তীরবর্তী অঞ্চলে এসে বাস করতে থাকে। রাজা ‘তৃতীয় রামসিস’ তাদেরকে দক্ষিণ ফিলিস্তিনের ‘বিলিস্ত’ নামক এলাকায় হিজরত করতে বাধ্য করে। এদেরকে বলা হতো ‘বিলিস্তিনিয়্যূন’। তারা ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসী কেনানী ও য়াবুসিদের পাশে বসবাস করতে থাকে। এখান থেকেই এসেছে ফিলিস্তিন শব্দটি। 

উল্লেখ্য যে, এরা ভূমধ্য সাগর এলাকা থেকে এলেও ফিলিস্তিনের বৈধ অধিবাসীই। কারণ শান্তিপূর্ণভাবেই সহাবস্থান করছিলো তারা।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৯০০ সালঃ ইবরাহীম, যিনি ইসলাম, ইয়াহুদ, খ্রিষ্ট, এই তিন ধর্মের জনক, ইরাক থেকে ভাতিজা লূত (আঃ)-কে সাথে নিয়ে ফিলিস্তিনে আসেন। এসে ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসী কেনানীদের সাথে বসবাস করেন। এবং এখানেই তার ঘরে জন্ম নেন ইসমাঈল ও ইসহাক (আঃ)। 

ইবরাহীমের ছেলে  ইসহাক আ. এর ঘরে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৭৫০ সালে জন্ম নেন ইয়া‘কুব, যার আরেক নাম ইসরাঈল।

এই ইয়াকুব বা ইসরাইলের ছিলো ১২ ছেলে। তাদের একজন হলেন ইউসুফ। পবিত্র কুরআনের ৫৩ নং সূরা যার নামে। এই সূরায় রয়েছে ইয়াকুব-ইউসুফের প্রসিদ্ধ ঘটনা। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ইউসূফ আ. তার ১১ ভাই কর্তৃক কূপে নিক্ষিপ্ত হন, তারপর সেখান থেকে বণিক দলের মারফতে মিশরে যান। সময়ের বিবর্তনে এই ইউসুফই হয়ে ওঠেন মিশরের অধিপতি। ইউসুফ তখন পিতা ইয়া‘কুবসহ পুরো পরিবারকে মিশরে নিয়ে যান। তারা সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানে এ পরিবারের বংশ বিস্তার হয়ে বিশাল এক গোষ্ঠিতে পরিণত হয়। এ গোষ্ঠিটিই পরবর্তীতে ইয়াকুব আ. এর নামানুসারে বনী ইসরাঈল ও তাঁর চতুর্থ ছেলে য়াহুদার নামানুসারে ইহুদী জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মিশরে তাদের ছিল সম্মান ও স্বাধীন জীবন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম ফেরাউনদের কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়। 

বলাই বাহুল্য, ইসহাকের ছেলে ইসরাইল থেকেই যত নবি রসুলগণ এসেছেন। নবুওয়ের ধারা এখান থেকেই জারি হয়েছে। আর ইয়াকুব বা ইসরাঈল তখন ফিলিস্তিনে ছিলেন। পুত্র ইউসুফের সুবাদেই কেবল মিশর গমণ করেছিলেন। 

বনি ইসরাঈল বা ইহুদি জাতির মূল বাসস্থান এই ফিলিস্তিন। এখানেই তাদের যত নবি রসুল অবতারের অবতারণা। এখানেই তাদের পুণ্যভূমি, এখানেই তাদের ইবাদত খানা। এখানেই তাদের মসজিদে আকসা। বনি ইসরাইল যখন ফেরাউন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেন, এরই মাঝে খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০ সালে মিশরে হযরত মুসা (আঃ) এর আত্মপ্রকাশ। 

তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনদের হাত থেকে বাঁচালেন। সাগড় পাড়ি, ফেরাউনের সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া, মূসা বনি ইসরাঈলকে নিয়ে সিনাই পর্বতে আসা, তুর পর্বতে যাওয়া, অনেক ঘটনাই ঘটে এর মাঝে। এরপর মূসা বনি ইসরাঈলকে নিয়ে ফিলিস্তিনের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছুলেন। 

ইতিহাস বলে, মূসা যখন বনি ইসরাঈলকে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের কথা বললেন, তখন তারা এই ভয়ে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায় যে এখানে দুর্ধর্ষ লোকেরা আছে। তারা বের হলে পরে আমরা সেখানে প্রবেশ করব।

এ অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ সেখানে তীহ নামক ময়দানে তাদরকে ৪০ বছর পর্যন্ত উদ্ভ্রান্তের মত রেখে দেওয়া হয়। এ ৪০ বছর তারা সেখান থেকে বের হওয়ার পথ পায় নি। এ সময়কালে তাদেরকে মান ও সালওয়া নামক বিশেষ খাবার দেওয়া হয়েছিলো। এবং এ সময়েই ঘটেছে হত্যাকারীকে বের করার জন্য গাভী জবাই করা সে বিখ্যাত ঘটনা। বিখ্যাত ঘটনাটিই এসেছে কুরআনেও। কুরআনের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারায়।

যাহোক, এ সময়সীমার শেষ দিকে এসে মুসা (আঃ) ইন্তেকাল করেন। এরপর আসেন নবী ইউশা ইবনে নুন। তিনি বনি ইসরাঈলকে নিয়ে জর্দান নদী পাড়ি দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১১৯০ সালে  ফিলিস্তিনের আরিহা নগরীতে আসেন এবং কেনানীদের একটি অংশ আমালেকা সম্প্রদাযের সাথে জিহাদ করে এ নগর বিজয় করেন।

যুদ্ধ করে নগর বিজয় করার বিষয়টি ছিলো অস্তিত্বের লড়াই। ধর্ম যুদ্ধ নয়। কারণ বনি ইসরাঈলরা এই ভূখন্ডেরই ছিলো। মাঝে মিশরে তারা অতিথি হিসেবে গেলেও আবার যখন ফেরাউনদের নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজ ভূমিতে আশ্রয় নিতে চাইলো, তখন সেখানে অন্য এক জাতি তাদের নিজ দেশে ঢুকবার, বসত করবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তাই যুদ্ধ করে জয় করতে হলো। 

এটি নিয়ে আপত্তি করা যায় না।

ইউশা ইবনে নুনের পর ইহুদীদের নেতৃত্বে আসে বিভিন্ন সর্দাররা। তাদের শাসনকাল চলে ১৫০ বছরের মত। 

এরপর আবার আমালেকা সম্প্রদায় তাদের উপর বিজয়ী হয়। তাদের উপর নির্যাতন চালায়। ধন সম্পদ লুটে নেয়। ছিনিয়ে নেয় তাদের অনেক ধর্মীয় পবিত্র জিনিস। এর মধ্যে একটি ছিল তাবুত। তাবুত হলো একটি বিশেষ বাক্স। এর মধ্যে কাষ্ঠখণ্ডে লিখিত তাওরাত, মুসা (আঃ)-এর ব্যবহৃত লাঠি এবং মুসা ও হারুন (আঃ)-এর পরিধেয় রক্ষিত ছিল। 

এরপর নবী সাময়ুলের মাধ্যমে তারা বাদশা তালুতের সাহায্য চায় এই আমালেকা থেকে মুক্তি পেতে।

১০২৫ সালে বাদশা তালূত বনী ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে আমালিকাদের সাথে নদী পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন। সে যুদ্ধে ১৬ বছর বয়সী যুবক দাউদ আমালেকাদের বাদশা জালুতকে হত্যা করলে আমালেকা সে যুদ্ধে পরাজিত হয়। দাউদ (আঃ) তালুতের কন্যাকে বিয়ে করেন। 

খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪ সালে তালুত মারা গেলে বনি ইসরাঈলের নেতৃত্ব দেন দাউদ। কিন্তু দাউদকে বনি ইসরাঈলের একটা অংশ অস্বীকার করে তালুতের ছেলেকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে।

দাউদের রাজধানী ছিলো আলখলিল নগরি। তালুতের রাজধানি ছিলো জেরুজালেম বা কুদস। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালে এক যুদ্ধে দাউদ তালুতের ছেলেকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেমকে রাজধানী বানান। এভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৯৫ সালের দিকে ইহুদীদের ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

দাউদ ৪০ বছর রাজত্ব করার পর তার ছেলে সুলাইমান আসেন। তিনিও ৪০ বছর রাজত্ব করেন। 

ইহুদীদের ইতিহাসে দাউদ ও সুলাইমান (আঃ) এ দুই যুগেই মোট ৮০ বছর স্বাধীনভাবে পূর্ণ প্রতাপের সাথে রাজ্য ক্ষমতা পেয়েছিল। কিন্তু এরপর আর তাদের নিরংকুশ স্বাধীন শক্তিশালী কোন রাজ্য ক্ষমতা লাভ করার সুযোগ হয় নি। সুলাইমানের মৃত্যু হলে ইহুদি রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়ঃ ইসরাইল রাজ্য ও য়াহুদা সাম্রাজ্য। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩০ সালে ইরাক থেকে অসুরীয়রা এসে ফিলিস্তিন দখল করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭২১ সালে ইসরাইল রাজ্য ধ্বংস করে।এরপর আসে বাবেলীয়ানরা। তারা ইহুদা রাজ্য ধ্বংস করে ফিলিস্তিন দখল করে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৭ সালে। তাদের রাজাসহ ১০ হাজার ইহুদিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ইহুদিদেরই একজনকে তাদের শাসক বানিয়ে দিয়ে যায়।

এই শাসক বাবেলীয়নদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ সালে বিদ্রোহের চেষ্টা করলে বাবেল থেকে রাজা বুখতে নসর এসে ফিলিস্তিনে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সমস্ত বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলে। বাইতুল মুকাদ্দাসকে ধ্বংস করে জ্বালিয়ে দেয়। ৪০ হাজার ইহুদীকে বন্দি করে নিয়ে যায়। বাবেল নগরীতে তারা গোলামীর জীবনে বাধ্য হয়। অবশিষ্ট ইহুদীরা ফিলিস্তিন এলাকা ছেড়ে প্রাণ নিয়ে মিশরের দিকে পালিয়ে যায়। ৫৬২ সনে বুখতে নসর মারা যায়। এ সময়ে এসে তারা নাযিল হওয়ার প্রায় ৭০০ বছর পর বিচ্ছিন্নভাবে তাওরাত লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে। বাবেলীয়দের ক্ষমতা চলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ পর্যন্ত। 

৫৩৯ সালে পারস্য রাজা দ্বিতীয় হুর্স বাবেলীয়নদের হটিয়ে তাদের সাম্রাজ্য দখল করে। এ ধারাবাহিকতায় শাম ফিলিস্তিনও তার কব্জায় আসে। হুর্স ইহুদিদেরকে বাবেল থেকে ফিলিস্তিন যাওয়ার অনুমতি দেন। কিছু ইহুদি বাবেলে থেকে গেলেও ৪০/৪২ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিন আসে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৫ থেকে ২ শ বছর ইহুদিরা এ রাজ্য পরিচালনা করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে ইতিহাসখ্যাত গ্রিক রাজা আলেকজান্ডার ফিলিস্তিন দখল করেন। ৩২৩ সালে তিনি মারা গেলে গ্রিক সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে আনবাতরা ফিলিস্তিন দখল করে। তারা প্রায় একশ বছর ফিলিস্তিন শাসন করবার পর ১৬৭ সালে সালুকি সম্প্রদায় আবার এ এলাকা দখল করে ইহুদিদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়।

এক পর্যায়ে সালুকিরা ইহুদিদেরকে কুদস তথা জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৩ সালে তারা সিমন নামে একজন ইহুদী শাসকও নিয়োগ দেয়।  শুরু হয় সিমনের সাম্রাজ্য। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৬ সাল পর্যন্ত এ রাজ্য ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে রাষ্ট্রিয়ভাবে তখনও তারা সালুকি গ্রীকদের অধীনেই ছিল। 

প্রিয় দর্শক এর পর ফিলিস্তিনের মাটিতে আগমন হয় রোমানদের। তারা এসে গ্রীক সাম্রাজ্যের পতন ঘটায় এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩ সালে জেরুজালেম দখল করে। এরপর খ্রীষ্টপূর্ব ১৫ সনে কুদসে মারিয়াম (আঃ)-এর জন্ম হয়। মারইয়াম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার গর্ভে ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হয় প্রকাশ্য কোনো বিয়ে শাদি এবং পুরুষের স্পর্শ ছাড়া। কিন্তু ঈসার জন্মটিকে ইহুদিরা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এটিকে ব্যাভিচার বলে দাবি করে। 

ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দ্বন্দ্বের সূচনা এখান থেকেই।

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের প্রিয় নবীর জন্ম। ঈসা নবীর জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পর মোহাম্মদ নিজেকে নবী দাবি করলেন। পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠিত প্রধান দুটি ধর্ম ইহুদি খ্রিষ্টানদের সমস্ত নবী, তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ সবকিছুকে উড়িয়ে বা এড়িয়ে না গিয়ে, ভালোভাবে জেনে মেনে নিয়েই তিনি নিজেকে নবী দাবি করলেন। কারণ ইহুদিরা তাদের বনি ইসরাঈল থেকে তাদের শেষ নবীর অপেক্ষা করছিলেন।

এদিকে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু নিয়ে ছিলো সংশয়। কেউ বলেছেন তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে আকাশে, কেউ বলেছেন তিনি খুন হয়েছেন।

যাই হোক, প্রিয় নবী ইবরাহিমের দ্বিতীয় পুত্র ইসমাইলের বংশধর বলে দাবি করলেন। ইতিপূর্বে বনি ইসরাঈলের সমস্ত নবী রসুল ইসহাকের বংশধর থেকেই এসেছিলেন।

এক কথায় পূর্ববর্তী ধর্ম দুটির অনুকরণে ও সমর্থনে নবী মোহাম্মদও নিজেকে একজন নবী হিসেবে দাবি করলেন। কিন্তু অধিকাংশ ইহুদি খ্রিষ্টানরা নবীকে বিশ্বাস করেননি।

কেন করেননি, সেটি নাহয় একটু পরে বলছি। তার আগে সংক্ষেপে ঈসার জন্ম থেকে শেষ নবী মোহাম্মদের জন্মের মধ্যবর্তী এই ৬০০ বছরের ফিলিস্তিনের ইতিহাসটি সংক্ষেপে জেনে নেই।

ঈসার জন্ম স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক, যেকোনো ভাবেই হলো। তাই এখন থেকে খ্রিষ্টপূর্ব সাল বলা হবে না। খ্রিষ্টাব্দ বলা হবে। কারণ যিশুখ্রিষ্টের জন্ম সাল থেকেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার  গণনা শুরু হয়।

আগেই বলেছি ঈসাকে ইহুদিরা মানত না। ঈসার সময়ে তিনজন নবী বর্তমান ছিলেনঃ যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা। এরা তিনজন মিলেই ইহুদিদেরকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করবার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু ইহুদিরা সব সময়, সর্বযুগেই জাগতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আধ্যাত্মিকতায় নয়। তারা যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকেই হয়তো কোনো কথা বা মতাদর্শ গ্রহণ করতে চাইতেন। সেকারণে তাদেরকে বোঝানোটা কঠিন হয়ে পড়তো।

যাই হোক, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দ্বন্ধ, ক্ষমতার লড়াই, অস্তিত্বের লড়াই, ক্ষমতা এবং সিংহাসনের পালাবদল চলতেই থাকে দীর্ঘ ৬০০ বছর ধরে। ঈসার জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পর ইসলামের নবীর যখন আগমণ হয়, তখন ফিলিস্তিন ছিলো পূর্ব রোমের রাজধানী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীন।

কারণ ৩৯৫ সালে রোম সাম্রাজ্য পুর্ব পশ্চিমে ভাগ হয়ে যায়। পূর্ব অংশের রাজধানী হয় বাইজান্টাইন। এর সম্রাট হল হিরাক্লিয়াস। ফিলিস্তিন অঞ্চল এ সাম্রাজ্যেরই অধীনে যায়। আর পশ্চিম অংশ হল ইউরোপ এলাকায়। এর রাজধানী হল রোম নগরী। 

পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্য ৪৭৬ সালে জর্মানদের হাতে পতন হলেও পূর্ব রোম টিকে ছিল এবং ফিলিস্তিনেও তাদের কব্জা ধরে রেখেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়কাল পর্যন্ত এ দৃশ্য বহাল থাকে। এক কথায় নবী মোহাম্মদের আমলে, মুসলিমদের আমলে ফিলিস্তিন ছিলো রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীনে।

এভাবেই যুগে যুগে ইহুদিরা নিজের ভূখণ্ড থেকেই কখনো হয়েছে নির্বাসিত, কখনো বা নির্যাতিত, হয়েছে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত।

একেশ্বরবাদী চারটি ধর্মেরই জনক ইবরাহিমের ভূখণ্ড এই ফিলিস্তিন। ইসলাম অনুসারেই বনি ইসরাইলের সকল নবী রসুলের জন্মভূমি এই ফিলিস্তিন।

ইবরাহিমের সন্তান ইসহাকের বংশধর থেকেই প্রায় এক লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বরগণের সকলেই এসেছে এই ফিলিস্তিন থেকে। ইসলামের নবী আসলেন আরবে। নিজেকে দাবি করলে ইবরাহীমের অপর সন্তান ইসমাইলের বংশধর। ইসমাঈল থেকে একজন নবীই আসলেন। তিনি মোহাম্মদ।

ইহুদিদের তীর্থভূমি যে ফিলিস্তিন, ইহুদিদের কিবলা যে ফিলিস্তিন, ইহুদিদের সমস্ত নবী রসুলগণের জন্মভূমি ও পুণ্যভূমি যে ফিলিস্তিন, সেই ফিলিস্তিন থেকেই তাদের উৎখাত হতে হয়েছে যুগে। 

এই পর্বে ইসলামের আগমন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ইতিহাস আলোচনা করা হলো। দ্বিতীয় পর্বে নবীর আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইহুদি জাতির ইতিহাস তুলে ধরা হবে। ইহুদিদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক ও ব্যবহার কেমন ছিলো তা জানলে আপনার পিলে চমকে ওঠতে পারে।

মুফতি ইমরান বিন বশির, ইসলামের ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন

প্রবীর কুমার সরকার ক্ষুদ্রঋণ দাতা গ্রামীণ ব্যাংকসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা, সারাবিশ্বে আলোচিত নোবেল বিজয়ী এবং মার্কিন ডিপস্টেট তথা সরোস-ক্লিনটন-বিল গেটসদের বন্ধু মুহাম্মদ ইউনূসের চরিত্রের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ছোটবেলা থেকেই মিথ্যা বলা, লোভ করা, কর ফাঁকি দেয়া, ষড়যন্ত্র করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, উপকারীর স্বীকৃতি না দেয়া, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, আত্মগরিমা এবং অন্যের

শারমিন জাহান অর্পি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আজ এক গভীর সংকটে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার ফলে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধে দলটির জন্ম, সংগ্রাম, সাফল্য এবং সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হলো। উৎপত্তি: