শারমিন জাহান অর্পি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আজ এক গভীর সংকটে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার ফলে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধে দলটির জন্ম, সংগ্রাম, সাফল্য এবং সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হলো।
উৎপত্তি: রোজ গার্ডেনের সূচনা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে। সে সময় এটি ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, পরে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে রাখা হয় শুধু ‘আওয়ামী লীগ’—যার অর্থ ‘জনগণের দল’। দলটির জন্মই হয়েছিল পাকিস্তানের একচেটিয়া শাসন এবং বাঙালিদের বঞ্চনার প্রতিবাদ হিসেবে।
প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, আর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
ছয় দফা, নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ঘোষিত ছয় দফা দাবিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা বলা হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি আখ্যা দিলেও এই ছয় দফাই পরে became the foundation of the liberation movement.
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় গণআন্দোলন এবং অবশেষে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১: স্বাধীনতার নেতৃত্ব
মার্চ ৭ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত ভাষণ এবং ২৬ মার্চ তার স্বাধীনতার ঘোষণা এই দলকে পরিণত করে জাতির পিতার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাকামী শক্তিতে। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নির্দেশনা, প্রবাসী সরকারের গঠন, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ইত্যাদি দিক থেকে দলটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ও ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডি
১৯৭২ সালে নতুন বাংলাদেশের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে নানা চ্যালেঞ্জ—দুর্ভিক্ষ, সামরিক-প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার মাঝে বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালু করেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য সেনাবাহিনীর একদল অফিসারের হাতে নিহত হন। আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ হয়, নেতারা আত্মগোপন বা নির্বাসনে চলে যান।
সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক পুনরুত্থান
এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসনকাল—জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগকে কঠোর দমননীতি মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা এবং দলের হাল ধরেন।
১৯৯৬ সালে দীর্ঘ বিরোধী আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় আসে এবং তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনা করে আসছে।
২০০৮–২০২৩: দীর্ঘ শাসনকাল ও বিতর্ক
এই সময়কালকে কেউ বলেন “উন্নয়নের দশক”, আবার কেউ বলেন “গণতন্ত্র সংকুচিত হওয়ার যুগ”। পদ্মা সেতু, ডিজিটাল বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার—সবই এই সরকারের বড় অর্জন। কিন্তু বিরোধীদলীয় রাজনীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এবং নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এই সময়কে প্রশ্নবিদ্ধও করে।
২০২৫ সালে নিষেধাজ্ঞা: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
২০২৫ সালের মে মাসে সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ ছিল—”রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ”। এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তীব্র বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি ‘পলিটিক্যাল উইপআউট প্ল্যান’। ১৯৭৫ সালে সামরিকভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এবার তা ঘটলো ‘আইনি ভাষ্য’ দিয়ে। সামাজিক মাধ্যমে দাবি উঠছে—এই নিষেধাজ্ঞা একটি ঐতিহাসিক ভুল যা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাকে অপমান করে।
প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ
নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ হয়েছে। এনসিপি, ছাত্র ইউনিয়ন, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অনেকেই শাহবাগ ও প্রেস ক্লাব এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়েছে।
বিএনপি বলেছে, নিষেধাজ্ঞা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিষয়, তারা এতে হাত দেবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল লক্ষ্যই আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া।
উপসংহার: একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর
আওয়ামী লীগ কি একটি নিছক রাজনৈতিক দল, নাকি এটি বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের প্রতীক? যারা দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে, তারা কি ইতিহাসকে নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত—বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯৪৯ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে, আওয়ামী লীগ ছিল, আছে, এবং থাকবে।
শারমিন জাহান অর্পি, লেখক এবং অনলাইন এক্টিভিস্ট