ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযানের তৃতীয় বছরে এসে রুশ বাহিনীর প্রাণহানির হার নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বিবিসি রুশ সার্ভিসের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে রুশ সেনাদের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকা দখলের জন্য গড়ে ২৭ জন করে সেনাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
এই হিসাব নির্ধারিত হয়েছে ২০২৪ সালে অনুমিতভাবে ১ লাখ ১২ হাজার রুশ সেনার প্রাণহানির ভিত্তিতে। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতদের তথ্য উন্মুক্ত সূত্র থেকে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি, স্বতন্ত্র রুশ গণমাধ্যম মিডিয়াজোনা এবং একদল স্বেচ্ছাসেবক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত রুশ বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময় ছিল ২০২৪ সাল। এ বছর এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৫ হাজার ২৮৭ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২২ সালে নিহত হন অন্তত ১৭ হাজার ৮৯০ জন এবং ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৬৩৩।
বিবিসির তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৬ হাজার ৭৪৫ জন নিহত সেনার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এটি প্রকৃত সংখ্যার ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ মাত্র। সে হিসেবে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা হতে পারে ১ লাখ ৬৪ হাজার থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজারের মধ্যে।
২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল রুশ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই দিন দোনেৎস্কের ভলনোভাখা শহরের কাছে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীর HIMARS ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রাশিয়ার ৩৬তম মোটরাইজড রাইফেল ব্রিগেডের অন্তত ৬৫ সেনা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ২২ বছর বয়সী আলদার বাইরভ, ৩১ বছর বয়সী ওখুঞ্জন রুস্তামভ এবং ৩২ বছর বয়সী ইগর বাবিচ। এ হামলায় আরও বহু সেনা আহত হন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই দিনেই রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ‘সাফল্য’ তুলে ধরেন, যদিও প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে ওই প্রাণঘাতী হামলার কথা রাশিয়ার সরকারি কোনো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
বিবিসির বিশ্লেষণ বলছে, যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে রুশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির হার ছিল ওঠানামা করা। তবে ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা মাসের পর মাস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আভদিভকা, রোবোটাইন, পোক্রোভস্ক এবং তোরেতস্কের লড়াইয়ে রুশ বাহিনী ব্যাপক প্রাণহানি দেখেছে।
শুধু ২০২৪ সালের আগস্টের ৬ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যেই ইউক্রেন সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে অন্তত ১ হাজার ২২৬ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।
মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রুশ বাহিনী পূর্ব ইউক্রেনে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। ওই সময়ে তারা ছোট ছোট সাঁজোয়া ইউনিট নিয়ে একের পর এক আক্রমণ চালায়, যা হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (ISW) এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ২ হাজার ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে।
তবে সামরিক কৌশল বিশ্লেষকদের মতে, এই অগ্রগতির তুলনায় রুশ বাহিনীর প্রাণহানির হার অনেক বেশি, যা রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও সেনাবাহিনীর মনোবলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।